বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলে করতে হবে যুদ্ধ!
বিবাহ হচ্ছে এমন একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দুজন নর-নারী একটি দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে। কখনও পারিবারিক সম্মতিতে আবার কখনও নিজেদের পছন্দে। দেশ-কাল-পাত্র ও ধর্ম-বর্ণভেদে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা এবং আনুষাঙ্গিকতা অনেকটা ভিন্ন হয়।
সবসময় মানুষ ঘর বাঁধে একসাথে আজীবন চলার লক্ষ্যে এবং উভয়ই যদি আল্লাহর নেক বান্দা হয়ে থাকে তাহলে এই জুটি মৃত্যুর পরে জান্নাতেও একত্র থাকতে পারবে। মজার ব্যাপার হলো দুনিয়ার জীবনে মনোমালিন্য বা বিদ্বেষ থাকলেও জান্নাতে শুধুই প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও প্রশান্তি লাভ করবে।
মানুষ বিয়ে-শাদি করে পরস্পর থেকে সুখ ও শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কাক্সিক্ষত প্রশান্তি লাভে ব্যর্থ হয়ে মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যেই শান্তি খুঁজে। কিন্তু শান্তি তখন সোনার হরিণ হয়ে পড়ে। পিতা-মাতা, বন্ধুমহল ও সমাজ তাদেরকে ভালো চোখে দেখে না। বিবাহ বিচ্ছেদে পুরুষ অপেক্ষা নারী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর চাওয়ার প্রেক্ষিতেই বিচ্ছেদ ঘটে।
স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য কিংবা সম্পর্কে একঘেয়েমি বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। তবে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। এটি এখন খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। আদালতে আবেদন করলেই ঝামেলা মিটে যায়। স্বামী বা স্ত্রী যেই আবেদন করুক, আদালত তাদের নিয়ম অনুযায়ী পদ্ধতি মেনেই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত দেন।
এরপর দুজনই মুক্ত। তবে মধ্যযুগে এত সহজ ছিল না বিবাহবিচ্ছেদ। এজন্য স্বামী-স্ত্রীকে তুমুল লড়াই করতে হতো। বিবাহবিচ্ছেদ এমন একটি বিষয়, যা যুগে যুগে নাটক এবং কৌতুক লেখকদের জন্য অফুরন্ত উপাদান সরবরাহ করেছে। ইউরিপিডস থেকে শেক্সপিয়ারের অনেক লেখায় উঠে এসেছে বিবাহবিচ্ছেদের কথা।
ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক কেনেথ হজেস একটি মধ্যযুগীয় জার্মান পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। সেখানেই পাওয়া যায় ‘যুদ্ধের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ’ এর নিয়ম। এই বইটি হাতে লেখা হয়েছিল ১৪৬৭ সালে।
স্বামী-স্ত্রী যখন আদালতে আবেদন করতেন বিবাদবিচ্ছেদের জন্য তখন সে সময় যুদ্ধের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন হতো। তখন তাদের এক জীবন-মরণ যুদ্ধে লড়াই করতে হতো। এই যুদ্ধে যে জিতবে তার কথাই মেনে নেওয়া হবে।
স্বামীকে কোমর পর্যন্ত বা ৩ ফুট একটি গর্তে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো প্রথমে। হাতে থাকত লাঠি, বল্লমসহ বিভিন্ন অস্ত্র। তবে এগুলো থাকত ভোঁতা। অন্যদিকে স্ত্রী থাকতেন গর্তের উপরে। হাজার হাজার মানুষ এই লড়াই দেখতে হাজির হতেন আদালত প্রাঙ্গণে। এ সময় তারা একধরনের বিশেষ বডিস্যুট পরতেন।
এই যুদ্ধে বেশিরভাগ সময়ই স্ত্রীরা জিতে যেতেন। কারণ তারা থাকতেন স্বাধীন অবস্থায়। যেহেতু স্বামীদের গর্তে কোমর পর্যন্ত ঢাকা থাকত; সেকারণে খুব বেশি লড়াই করতে পারতেন না তারা।
স্ত্রীরা তাদের মেরে অজ্ঞান করে ফেলতেন। আবার মাঝে মাঝে প্রাণ রক্ষার বিনিময়ে দোষ স্বীকার করতেও বাধ্য করা হতো স্বামীদের।
এই লড়াইয়ের নিয়ম ছিল, স্ত্রীরা চাইলে স্বামীদের গর্ত থেকে টেনে বের করে আনতে পারবেন। আবার স্বামীরা স্ত্রীদের গর্তের ভেতর টেনে নিয়ে যেতে পারবেন। মূল কথা হলো লড়াইয়ে জেতা। কারণ এই লড়াই শুধু যে বিবাহবিচ্ছেদই নিশ্চিত করবে না, প্রাণটাও রক্ষা করবে।
যুদ্ধে স্বামী হেরে গেলে তাকে শহরের মাঝখানে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। স্ত্রী হেরে গেলে তাকে সবার সামনে জীবন্ত কবর দেওয়া হবে। এটাই ছিল তাদের শেষ পরিণতি।
লড়াইয়ের পর তো বটেই, লড়াই করার সময়ও অনেকে মারা যেতেন। বেশিরভাগ সময় নারীরাই মারা যেতেন। কারণ একবার স্ত্রীকে গর্তে টেনে নিতে পারলে আর তার বাঁচার উপায় ছিল না। তবে পুরুষদের তালিকাও ছোট ছিল না।
যুদ্ধ দ্বারা বিচার ছিল জার্মানিক আইনের একটি অংশ। যা দুটি পক্ষের মধ্যে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করত। সে সময় সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার হতো না। লড়াইয়ে যে জিতবে, তার অভিযোগই সত্য বলে ধরে নেওয়া হবে। অন্যজন শাস্তি ভোগ করবে। এটি যে শুধু বিবাহবিচ্ছেদের জন্যই হতো তা নয়। লড়াই হতো অন্যান্য বিচারের ক্ষেত্রেও।
বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। মহামারির মতো সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা। অর্থনৈতিক কারণে অশান্তির কারণেও ভাঙন ধরেছে অনেক সংসারে। রাজধানী ঢাকায়ই দিনে ৩৮টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি মাসে ৯৯টি বিচ্ছেদ বেড়েছে। স্বার্থের সংঘাত, অর্থের অভাব, পর নর-নারীতে আসক্ত ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, যৌতুক, মতের অমিল আর আত্মসম্মান মোকাবিলায় চূড়ান্ত হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন নারীরাই।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ভাঙছে একটি সংসার। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন নারীরা, ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। তবে এটা কেবল শহরের হিসাব। করোনার ধাক্কায় আয় সংকুচিত হয়েছে বহু মানুষের। তবে সংকটকালের এই অভিঘাত এখানেই থেমে নেই।